"মহাবিশ্বের প্রকৃত রঙের রহস্য কী?"
মহাবিশ্বে নেবুলা ও তারার ছবিছবি: শাটারসস্টক
মহাবিশ্বের প্রকৃত রং: আমরা যা দেখি আর বাস্তবে যা আছে
মহাবিশ্বের রঙ: এক বিস্ময়কর বিশ্ব
আজকের যুগে, যখন আমরা হাবল টেলিস্কোপ কিংবা নতুন প্রজন্মের জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের পাঠানো মহাকাশের ছবি দেখি, তখন আমরা এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হই। অসীম মহাকাশে ছড়িয়ে থাকা রঙিন নীহারিকা, ঝলমলে ছায়াপথ, তারার ঝলক, আর এক অগণিত মহাজাগতিক বস্তু—এসব দেখে মনে হয় যেন মহাবিশ্ব এক বিশাল রঙের ক্যানভাস, যা প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন রঙের ছবি তৈরি করছে। কিন্তু, যেসব ছবি আমরা দেখি, সেগুলোর রং কি সত্যিই মহাবিশ্বের প্রকৃত রং? কিংবা, মহাবিশ্বের প্রকৃত রং কী? এর উত্তর জানলে হয়তো আপনি অবাক হবেন।
মহাবিশ্বের প্রকৃত রং: কিভাবে জানবো?
মহাবিশ্ব থেকে আমাদের কাছে যে আলোকরশ্মি আসে, তার বেশিরভাগই আমাদের চোখে দৃশ্যমান নয়। আমাদের চোখ শুধুমাত্র দৃশ্যমান তরঙ্গদৈর্ঘ্য (৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার) শনাক্ত করতে পারে, যা লাল থেকে বেগুনি রঙ পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে মহাকাশে যে আলোর বিস্তৃতি রয়েছে, তা এ থেকে অনেক বেশি। মহাবিশ্বের আলোকরশ্মি বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বিকিরিত হয়—অবলোহিত (ইনফ্রারেড), অতিবেগুনি (আলট্রাভায়োলেট), এক্স-রে, গামা রশ্মি, এবং আরো অনেক ধরনের রশ্মি। কিন্তু, যেহেতু আমাদের চোখ এই আলোগুলো দেখার ক্ষমতা রাখে না, আমাদের কাছে মহাবিশ্বের প্রকৃত রং অদৃশ্য থাকে।
মহাবিশ্বের রঙিন ছবি: কিভাবে তৈরি হয়?
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যখন মহাজাগতিক বস্তু বা দূরবর্তী গ্যালাক্সির ছবি তোলেন, তখন তাঁরা শুধু দৃশ্যমান আলো নয়, বরং অন্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশ্মিও সংগ্রহ করেন। অতিবেগুনি, অবলোহিত, এক্স-রে, বা গামা রশ্মির মতো অদৃশ্য আলো ছবি তোলার জন্য ব্যবহার করা হয়। এর পর, সেই অদৃশ্য আলোকরশ্মি আমাদের চোখের জন্য দৃশ্যমান করতে বিজ্ঞানীরা কালার-ম্যাপিং বা ফলস কালার ইমেজিং নামক কৌশল ব্যবহার করেন।
এই প্রক্রিয়ায়, নানা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর বিকিরণকে নির্দিষ্ট রঙে রূপান্তর করা হয়। উদাহরণস্বরূপ:
-
অবলোহিত (ইনফ্রারেড) বিকিরণ → লাল বা সবুজ
-
অতিবেগুনি (আলট্রাভায়োলেট) বিকিরণ → নীল বা বেগুনি
-
এক্স-রে বিকিরণ → উজ্জ্বল, সাদা বা অন্য কোনো উজ্জ্বল রঙ
তাহলে, যে রঙিন ছবি আমরা দেখি, তা আসলে বৈজ্ঞানিকভাবে তৈরি একটি কৃত্রিম রঙিন উপস্থাপনা। প্রকৃত মহাবিশ্বের দৃশ্যের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। এর মানে হলো, সেই ছবিগুলো আমাদের কাছে মহাবিশ্বের সৌন্দর্য প্রকাশ করলেও, তা প্রকৃত রঙের কোনো সঠিক প্রতিফলন নয়।
মহাবিশ্বের রং নির্ধারণ: প্রকৃত রং কি?
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে মহাবিশ্বের প্রকৃত রং কী? প্রকৃতপক্ষে, মহাবিশ্বের কোনো নির্দিষ্ট রং নেই, কারণ এটি একেকটি বস্তু, নক্ষত্র, গ্যাস বা ছায়াপথের আলোর নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ওপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ:
-
নক্ষত্রের রং:
নক্ষত্রের রং তাদের তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে। শীতল নক্ষত্রগুলো লালচে রঙের হয়, যেমন প্রাচীন নক্ষত্র বা নিম্ন তাপমাত্রার নক্ষত্র।
মাঝারি তাপমাত্রার নক্ষত্র যেমন আমাদের সূর্য, হলুদ রঙের দেখায়।
আর অত্যন্ত উত্তপ্ত নক্ষত্র নীল বা সাদা দেখায়। -
গ্যালাক্সির রং:
গ্যালাক্সির রংও নক্ষত্রের বয়স, প্রকারভেদ এবং ধূলিকণার উপস্থিতির ওপর নির্ভর করে। নবীন নক্ষত্র সমৃদ্ধ গ্যালাক্সি সাধারণত নীলচে দেখায়, আর পুরনো নক্ষত্র বা ধূলিকণার প্রভাবিত গ্যালাক্সি হলুদ বা লালচে রঙ ধারণ করে। -
নীহারিকার রং:
গ্যাসীয় নীহারিকার রং নির্ভর করে গ্যাসের উপাদান এবং নক্ষত্রের যে আলো তাদের ওপর প্রতিফলিত হচ্ছে তার ওপর। যেমন, হাইড্রোজেন গ্যাসের বিকিরণে নীহারিকা লালচে রঙ ধারণ করে।
মহাবিশ্বের গড় রং: কসমিক ল্যাটে
যেহেতু মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু আলাদা আলাদা আলোক বিকিরণ করে, এর প্রকৃত রং নির্ধারণ করা কঠিন। তবে বিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন এবং প্রায় ২ লাখেরও বেশি গ্যালাক্সির আলো বিশ্লেষণ করে একটি গড় রঙ নির্ধারণ করেছেন। তাদের পরীক্ষায় দেখা গেছে, মহাবিশ্বের সম্মিলিত আলো মূলত হালকা সাদা বা অফ-হোয়াইট রঙের কাছাকাছি, যা ইংরেজিতে "বেজ কালার" নামে পরিচিত।
তাদের এই গবেষণার পর, যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় মহাবিশ্বের এই গড় রঙের জন্য একটি নাম রেখেছে: "কসমিক ল্যাটে"। ল্যাটে কফির মতো হালকা ক্রিম রঙের এই নামটি নির্বাচন করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে একটি ভোটাভুটিও হয়েছিল, যেখানে কয়েকটি বিকল্প নামের মধ্যে ছিল "ক্যাপাচিনো কসমিকো", "বিগ ব্যাং বাফ", "কসমিক ক্রিম" ইত্যাদি।
মহাবিশ্বের রং: এক বিবর্তনশীল চিন্তা
মহাবিশ্বের প্রকৃত রং আসলে নির্দিষ্ট একটি রঙে সীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন ধরণের আলোকরশ্মি, তাপমাত্রা, বস্তু, নক্ষত্রের গঠন এবং অন্যান্য অনেক উপাদান এই রঙের ধারাকে পরিবর্তন করে। তাই, যখন আমরা মহাবিশ্বের রং নিয়ে ভাবি, তখন এটি আমাদের কল্পনা ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের এক মিশ্রণ হয়ে ওঠে, যা সঠিক ও সীমাবদ্ধ কোনো নির্দিষ্ট রংয়ে বন্দি হতে পারে না।
উপসংহার
মহাবিশ্বের প্রকৃত রং এবং তার সৌন্দর্য আমাদের জন্য এক অবিস্মরণীয় রহস্য। হাবল এবং জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের ছবিগুলো সেই রহস্যের এক অভূতপূর্ব প্রতিফলন। তবে, মহাবিশ্বের আসল রং আমরা কখনোই সঠিকভাবে দেখতে পাবো না, কারণ সে রং আমাদের চোখের সীমাবদ্ধতার বাইরে। তবুও, বিজ্ঞানীরাও তাদের কৌশল ব্যবহার করে আমাদের জন্য এক নতুন দৃষ্টিকোণ তৈরি করেছেন, যা মহাবিশ্বের রঙিন ছবি দেখতে আমাদের সক্ষম করে তোলে। কসমিক ল্যাটে—এটাই মহাবিশ্বের গড় রঙ, কিন্তু তার প্রকৃত রঙ কখনোই চিরকাল অজানা থেকে যাবে।
https://experimentscalp.com/zfzf74p0t3?key=7f24f7040ea7e97aaa0a9bb92f4e7146
Post a Comment