‘খাম্বা চক্র’: পল্লী বিদ্যুতের অজানা অন্ধকার
পল্লী বিদ্যুতে ‘খুঁটি সিন্ডিকেট’: চার প্রতিষ্ঠানের দাপট
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) অধীন প্রকল্পগুলোতে বিদ্যুতের খুঁটি সরবরাহে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল চারটি প্রতিষ্ঠানের হাতে। এগুলো হলো—জেমকন গ্রুপ, কনটেক কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, টিএসসিও পাওয়ার লিমিটেড এবং গ্লোরি পোল। প্রতিষ্ঠানগুলো তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
আরইবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৮ লাখ ৮১ হাজার খুঁটি কেনা হয়েছে, যার ব্যয় প্রায় ৫,৩০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫৬ শতাংশ সরবরাহ করেছে ওই চারটি প্রতিষ্ঠান।
-
জেমকন গ্রুপ পেয়েছে ৯০১ কোটি টাকার কাজ (১৭%)
-
কনটেক কনস্ট্রাকশন পেয়েছে ৮৪৮ কোটি টাকার কাজ (১৬%)
-
টিএসসিও পাওয়ার পেয়েছে ৬৮৯ কোটি টাকার কাজ (১৩%)
-
গ্লোরি পোল পেয়েছে ৫৩০ কোটি টাকার কাজ (১০%)
সংশ্লিষ্টরা জানান, দরপত্র ব্যবস্থাকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছিল যে, এই চক্রের বাইরে কেউ দরপত্রে অংশ নিতে সাহস পেত না। কেউ অংশ নিলেও কাজ পেত খুব সামান্য। দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির বিষয়টি ধরা পড়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সিপিটিইউর পর্যবেক্ষণে, তবে রাজনৈতিক আশ্রয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
প্রাক্তন সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের মালিকানাধীন জেমকন গ্রুপ, কনটেকের চেয়ারম্যান মোখলেসুর রহমান, টিএসসিওর এমডি ছিলেন সাবেক এমপি শফিউদ্দিন শামীম এবং গ্লোরি পোলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল সরকারের প্রভাবশালীদের।
এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তারা সময়মতো খুঁটি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় দাম নিয়ন্ত্রণ করে এবং সরকারের আর্থিক ক্ষতি করে।
এ ধরনের একচেটিয়াত্ব কেবল খুঁটি নয়, প্রিপেইড মিটার ও ট্রান্সফরমার কেনার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে।
-
প্রিপেইড মিটার সরবরাহে ‘ভাই-বন্ধু’ চক্রের পাঁচ প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণে ছিল: হেক্সিং, ইনহে মিটার, শেনজেন স্টার, ওয়াসিওন ও হোলি মিটার।
-
ট্রান্সফরমার সরবরাহে ২০১৫–২০২৪ সময়ে দুই প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করেছে মোট ২০০০ কোটি টাকার বাজার। এরা হলো টিএস ট্রান্সফরমার এবং ভিকার ইলেকট্রিক্যাল—দু’টি প্রতিষ্ঠানই এসকিউ গ্রুপের অংশ, যার সঙ্গে সাবেক বিদ্যুৎমন্ত্রী এবং এমপিদের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে।
আরইবির প্রকৌশল বিভাগ জানিয়েছে, ভবিষ্যতে দরপত্র প্রক্রিয়া এমনভাবে পরিচালিত হবে যাতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের সুযোগ না থাকে। তবে কার্যত এখনো তেমন উদ্যোগের বাস্তবায়ন চোখে পড়ছে না।
আগের কাজ পর্যালোচনা করা হচ্ছে
বর্তমানে আরইবির গ্রাহকসংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তিনটি প্রকল্পের কাজ চলছে। এতে মোট ব্যয় হচ্ছে ১১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। প্রকল্পগুলো হলো ৩ হাজার ৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা বিভাগের বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থার আধুনিকায়ন, ৭ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং ১ হাজার ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে বরিশাল বিভাগের বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থার আধুনিকায়ন প্রকল্প। এসব প্রকল্পেও খুঁটি কেনা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কুমিল্লা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খুঁটির অন্তত ২২টি কারখানা রয়েছে। প্রতিটি খুঁটির দাম এখন প্রায় ২৯ হাজার টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ১৬ হাজার টাকা। এতে বোঝা যায়, খুঁটির দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান ২৩ এপ্রিল প্রথম আলোকে বলেন, পল্লী বিদ্যুতে বিগত সময়ে খুঁটি সরবরাহের কাজ কারা কারা পেয়েছে, সেটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সে সময়ে তৈরি করা দরপত্রে কোনো ত্রুটি ছিল কি না, তা দেখা হচ্ছে। এই উপদেষ্টা আরও বলেন, ভবিষ্যতে আরইবির খুঁটি সরবরাহ প্রকল্পে এমনভাবে দরপত্র আহ্বান করা হবে, যাতে যোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্রে অংশ নিতে পারে। এটি নিশ্চিত করা গেলে কোনো ঠিকাদারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।
Post a Comment